ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস[দাদাসাহেব ফালকে কে ছিলেন]( দাদাসাহেব ফালকেবিষয়ক কিছু অযানা কথা)

ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাল ১৯১৩'। এই বছর ভারতবর্ষের কাহিনীচিত্র 'রাজা হরিশচন্দ্র' নির্মীত হয়, নির্মাণকারী ধূন্দিরাজ গোবিন্দ ফালকে (দাদাসাহেব ফালকে নামেই অধিক পরিচিত)। পৌরাণিক এই কাহিনীচিত্রে চিত্রশিল্প, সঙ্গীত এবং নাটকের মেলবন্ধন ঘটেছিল।

দাদাসাহেব ফালকে ওঁর পূর্বসূরি রাজা রবি বর্মার চিত্রশৈলী থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং ছবির চরিত্রের অর্থাৎ রাজা হরিশচন্দ্র, রাণী তারামতির সাজসজ্জায়, হাঁটা-চলায় রবি বর্মার প্রভাব খুবই স্পষ্ট। এছাড়া তৎকালীন মারাঠী নাট্যমঞ্চও ফালকে-কে প্রভাবিত করেছিল।

এই ছবির নির্মাণকালে দাদাসাহেব ফালকে রাণী তারামতির চরিত্রে কোন মহিলা না পেয়ে 'মিস্টার সালুস্তে' নামে --এক পুরুষকে রাণী তারামতি সাজিয়েছিলেন। হরিশচন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ডি. জি. ডাবকে।

'রাজা হরিশচন্দ্র' ১৯১৩ সালে নির্মীত হলেও এরকম ছবি করার কথা ফালকে ভেবেছিলেন ১৯১০ সালেই। সেই সময় 'দ্য লাইফ অফ ক্রাইস্ট' নামে একটি ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হন। ঠিক এরকমই ভারতীয় পুরাণের ভিত্তিতে একটি সম্পূর্ণ ভারতীয় চলচ্চিত্র তৈরি করবেন স্থির করেন।

ইতিপূর্বে ফালকে বিভিন্নরকম পেশায় যুক্ত ছিলেন।কলকাতাবাসী প্রথম চলচ্চিত্রের মুখোমুখি হন স্টার থিয়েটারে, সময় ১৮৯৬ সাল। কলকাতায় তখন থিয়েটারের রমরমা অবস্থা। এই সময় স্টার থিয়েটার-এর কর্তৃপক্ষের কাছে এসে মি. স্টিফেন্স নামে এক বিদেশী ভদ্রলোক প্রত্যেক রাতের অভিনয় শুরুর আগে স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র দেখাবার অনুমতি প্রার্থনা করেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন তখন যুবক। তিনি বিনোদনের এই নতুন উপাদানটি দেখে চমৎকৃত হন এবং উৎসাহিত হন। লণ্ডনের 'জন রেঞ্জ এন্ড সন্স' থেকে সিনোমাটোগ্রাফ মেশিন আনিয়ে কলকাতায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী শুরু করেন। এই কাজে তিনি সহযোগী হিসেবে টেনে নেন ছোট ভাই মতিলাল সেনকে।

তাঁরা প্রদর্শনীর জন্য বিদেশ থেকে ছবি আনাতেন। এছাড়া তৎকালীন বিখ্যাত সব থিয়েটারের অংশ তুলে তার প্রদর্শনী করতেন। যেমন, ভ্রমর, সীতারাম, গিরিশ ঘোষের 'মনের মতন', অমরেন্দ্রনাথ দত্ত'র 'মজা' ইত্যাদি।

১৯০০ সালে এঁরা তৈরি করেন রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানী  এটি ছিল বাংলার প্রথম সিনেমা কোম্পানী। এই কোম্পানীর নামেই এঁরা সর্বত্র ছবি দেখাতেন।

নাটকের দৃশ্যও তোলা ছাড়াও হীরালাল সেন বিজ্ঞাপন চিত্র তৈরি করেছিলেন, 'এডওয়ার্ড এন্ড ম্যালেরিয়া স্পেসিফিক' নামক ওষুধ এবং 'জবাকুসুম' তেলের বিজ্ঞাপন চিত্র তৈরি করেছিলেন। এছাড়াও ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে যে ঐতিহাসিক জনসভা হয়েছিল, পুরনো ট্রেজারি বিল্ডিং এর উপর থেকে সেই শোভাযাত্রার ছবি তুলেছিলেন হীরালাল সেন। ১৯১১ সালে দিল্লীতে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ও সম্রাজ্ঞী মেরীর ছবি তোলেন।১৮৬০ সালে মহারাষ্ট্রের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে ফালকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে জে. জে. স্কুল অফ আর্ট  এ ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। এরপর বরোদার কলাভবন-এ যোগ দেন। দুটি ক্ষেত্রে শিক্ষণের ফলে ফালকে শিল্পকলা (তেল রঙ এবং তল রঙ, ছাঁচনির্মাণ  লিথোগ্রাফ্‌  স্থাপত্যবিদ্যা  এবং ফটোগ্রাফিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ফালকে এই সময় মঞ্চাভিনয়েও যোগ দেন। তিনি যাদুবিদ্যাও রপ্ত করেছিলেন, যা ওঁর মতে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরি।

ভারত সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের আলোকচিত্রকর এবং লিথোগ্রাফার  হিসেবে কর্ম-জীবন, শুরু করেন। এরপর ফালকে নিজেই একটি মুদ্রণালয় স্থাপন করেন। এখানেই ফালকে লিথোগ্রাফির দ্বারা রবি বর্মার তৈলচিত্রের অনুকরণে তৈল-রঙে-রঞ্জিত নকল তৈরি করতেন।

'রাজা হরিশচন্দ্র' ১৯১৩ সালে ৩রা মে করোনেশন  -এ মুক্তিলাভ করে।

'রাজা হরিশচন্দ্র' অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল সমগ্র ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষের মানুষ এই প্রথম সম্পূর্ণ ভারতীয় বিষয়- বস্তু-নির্ভর একটি ভারতীয় ছবি দেখতে পেল। তারা ছবিটির সাথে একাত্মবোধ করে।

১৯১৭ সালে ফালকে "হিন্দুস্তান ফিল্ম কোম্পানি' তৈরি করেন। এই কোম্পানির প্রথম ছবি ছিল 'শ্রীকৃষ্ণজনম', (১৯১৮)। ১৯১৯ সালে তৈরি হয় কালীয়মর্দন'। এই ছবিতে ফালকের মেয়ে 'মন্দাকিনী' মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিল।

ফালকে মোট ১২০টি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন। ওঁর শেষ ছবি ছিল 'গঙ্গাবতরণ' (১৯৩৭)। ১৯৪৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি দানাসাহেব ফালকে পরলোক গমন করেন।

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
জনপ্রিয়
Sep 29, 2023, 3:57 AM Akash